আনুকূল্য নয়, ইসলামি মূল্যবোধকে ধারণ করে রাজনীতি করি

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার উদ্যোগ নেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতভিন্নতার কারণে আটকে আছে সেটা। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে একটা নজিরবিহীন ঘটনা যে এতগুলা দল একসঙ্গে বসে দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নিল। সেখানে একটা বড় দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনার অভিজ্ঞতাটা কী?

সালাহউদ্দিন আহমদ: এটা আসলেই ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিল, তাদের সঙ্গে একত্রে বসে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে তর্কবিতর্ক, অম্লমধুর সব আলোচনা এখানে হয়েছে। এর সবকিছুই রেকর্ডেড। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অবশ্যই একটি পরিবর্তনের আভাস।

প্রশ্ন : কিন্তু এর ফলাফল কী?

সালাহউদ্দিন আহমদ: এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণীত হওয়ার পথে। এই সনদ প্রণীত হলে, স্বাক্ষরিত হলে, বাস্তবায়িত হলে জাতীয় জীবনে আমি বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলব না, কিন্তু একটি বিশাল পরিবর্তন আসবে। যে পরিবর্তনটার জন্যই বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ আন্দোলন–সংগ্রাম করেছে। যেমন ভোটাধিকারের জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, সাংবিধানিক অধিকারের জন্য, নাগরিক অধিকারের জন্য। এই পরিবর্তনগুলো এই সংস্কারগুলো অবশ্যই প্রয়োজন আছে।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করছে বিএনপি। কথা বলছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করছে বিএনপি। কথা বলছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ

প্রশ্ন : মৌলিক পরিবর্তন কি আসবে? সংস্কার কমিশন কিছু মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছিল। সেখানে যেভাবে ঐকমত্য ও ভিন্নমতসহ সিদ্ধান্ত হলো, তাতে শেষ পর্যন্ত আসলে কতটুকু মৌলিক পরিবর্তন দেখতে পাব?

সালাহউদ্দিন আহমদ: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যে শব্দপ্রয়োগ, তার সবগুলোর সঙ্গে আমি একমত নই। সংবিধানে যেটাই পরিবর্তন আসবে, সেটাই মৌলিক পরিবর্তন হবে। তবে তার মধ্যে সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, সরকার পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জুডিশিয়াল ও নির্বাচন পরিচালনার বিষয়ে রিফর্মস, এগুলো অবশ্যই মৌলিক পরিবর্তন বলে ধরে নেওয়া যায়। ১৯টি বিষয়ে তাঁরা চিহ্নিত করেছিলেন মৌলিক পরিবর্তন হিসেবে। এখানে ১২টি বিষয়ে আমরা সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছি। বাকি সাতটা দফার মধ্যে আমাদের কিছু কিছু নোট অব ডিসেন্ট আছে, অন্যান্য দলের দুই-একটা নোট অব ডিসেন্ট আছে। এগুলো এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।

প্রশ্ন : যেসব ক্ষেত্রে আপনাদের নোট অব ডিসেন্ট আছে, যেমন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ। এই বিষয়গুলো কি আপনাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ থাকবে?

সালাহউদ্দিন আহমদ: আমাদের যে ৩১ দফা, তার ভিত্তিতে আমাদের নির্বাচন ইশতেহার হবে। বাংলাদেশে যে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, তাদের প্রত্যাশা, তাদের অঙ্গীকার, তাদের স্বপ্নকে আমরা ধারণ করে ইশতেহার তৈরি করব। আগামী দিনে তারুণ্যের যে রাজনৈতিক ভাবনা, সেটাকে আমরা ধারণ করব। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের যে প্রস্তাবনাগুলো আমাদের আছে, যেগুলো জাতীয় কমিশনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে, সেগুলো আমরা ধারণ করব। মোটামুটি আমরা বলতে পারি, এটাই হবে এই জাতির মুক্তির একটি সনদ।আমরা মনে করি, শুধু দলীয় প্রধান থাকার কারণে তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার তো ক্ষুণ্ন হতে পারে না প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে। সুতরাং আমরা মনে করি, এই অপশনটা খোলা রাখা উচিত।

প্রশ্ন : ভিন্নমতগুলোর (নোট অব ডিসেন্ট) কী হবে?

সালাহউদ্দিন আহমদ: ভিন্নমতগুলো এ রকম যে আমরা ঠিক এইভাবে একমত নই। কিন্তু আমাদের নোট অব ডিসেন্টসহ আমরা একমত। যেমন একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকলে তিনি লিডার অব দ্য হাউস থাকতে পারবেন, এ বিষয়ে সবাই একমত। কিন্তু দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না, এ বিষয়ে কারও কারও নোট অব ডিসেন্ট আছে, আমাদেরও আছে। যেমন আমরা মনে করি, শুধু দলীয় প্রধান থাকার কারণে তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার তো ক্ষুণ্ন হতে পারে না প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে। সুতরাং আমরা মনে করি, এই অপশনটা খোলা রাখা উচিত। বাংলাদেশের মানুষকে ওভার নাইট রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের দিকে আমরা নিতে পারব কি না, এটাও একটা বিষয়। আর পার্লামেন্টের প্র্যাকটিসটা হচ্ছে জনগণ তার সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ করে তাকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেন। তারা পার্লামেন্টের পার্টিতে যে দল মেজরিটি পাবে, তারা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। এটাই তো কমপ্লিট ডেমোক্রেটিক একটা প্রসেস। এখানে অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।

সালাহউদ্দিন আহমদ
সালাহউদ্দিন আহমদ

প্রশ্ন : এখানে একটা প্রশ্ন আসে, রাজনৈতিক দলগুলো, প্রায় সব দলেই গণতান্ত্রিক চর্চাটা ভেতরেই নেই। একজনই সবকিছু। যার ফলে উনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন এবং দলীয় প্রধান থাকেন, তখন দল, সরকার, সংসদ—সব একাকার হয়ে যায়।

সালাহউদ্দিন আহমদ: কথাটা সত্যি, বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা একটা প্রচলিত নিয়ম হয়ে গেছে। আসলে তা নয়। প্রতিটি স্তরে এখন সরাসরি নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আমাদের কমিটিগুলো গঠিত হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে থেকে। এই ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিসটা আমরা কেন্দ্রীয় সম্মেলনের ক্ষেত্রেও করতে চাই। তবে বাংলাদেশের মানুষকে ওভার নাইট রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের দিকে আমরা নিতে পারব কি না, এটাও একটা বিষয়। আর পার্লামেন্টের প্র্যাকটিসটা হচ্ছে জনগণ তার সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ করে তাকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেন। তারা পার্লামেন্টের পার্টিতে যে দল মেজরিটি পাবে, তারা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। এটাই তো কমপ্লিট ডেমোক্রেটিক একটা প্রসেস। এখানে অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।

প্রশ্ন : সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব হচ্ছে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন ছাড়া বাকি চারটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের সিদ্ধান্তেই বিএনপির আপত্তি আছে। তাহলে বিএনপি যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলে, সেটার প্রতিফলন তো হলো না।

সালাহউদ্দিন আহমদ: আমরা যে দৃষ্টিতে দেখি, তা হলো সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ—বিচার বিভাগ, আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ তার সাংবিধানিক সীমারেখার মধ্য থেকেই কর্মপরিচালনা করবে। আওয়ামী লীগের সময় যেভাবে বিচারপতিদের পার্লামেন্টের অধীন করা হয়েছিল ইমপিচমেন্টের জন্য, সেটা হচ্ছে সরাসরি হস্তক্ষেপ।
জুডিশিয়ারিকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার জন্য যে অঙ্গীকার আমাদের আছে এবং করা হচ্ছে; আর আইনসভা তার সাংবিধানিক এখতিয়ারের মধ্যে সে আইন প্রণয়ন করবে। নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে এসে নির্বাহী বিভাগকে যদি আমরা পঙ্গু করে দিই, নির্বাহী বিভাগের কর্মপরিচালনা করার জন্য তার যে এখতিয়ার আছে, এখানে যদি আমরা স্বাধীনতা না দিই বা সুচারুরূপে যদি কর্ম করতে না দিই, তাহলে নির্বাহী বিভাগ হবে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে পঙ্গু হিসেবে চলার মতো। কারণ, নির্বাহী বিভাগের পরিচালনার জন্য যাঁরা নির্বাচিত হন, তাঁরা সরাসরি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। নির্বাহী বিভাগকে দায়বদ্ধ থাকতে হয় জয়েন্টলি পার্লামেন্টের কাছে, কেবিনেটকে জয়েন্টলি দায়বদ্ধ থাকতে হয় পার্লামেন্টের কাছে। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের কাছে যদি কর্মপরিচালনা করার মতো অথরিটি না থাকে, যদি যথেষ্ট শক্তি-সামর্থ্য এবং আইনি অপশন না থাকে, তাহলে তারা সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না।

সে জন্য আমরা বলেছি, যেসব সংবিধিবদ্ধ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে আইন আছে, সেই আইনগুলো আমরা শক্তিশালী করব। তাতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করব। কিন্তু যদি একবার নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ হয়, ট্রায়াল অ্যান্ড এরর প্রসেসের মধ্য দিয়ে সেটা আবার সংশোধনের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এটা ডিফিকাল্ট হয়ে যাবে।
নির্বাচন কমিশন বাদে দুদক, পিএসসিসহ অন্য সংস্থাগুলো— সেখানে আমরা বলেছি আইনগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করি, যার মধ্য দিয়ে সেসব সংস্থার জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু কোনো অঙ্গকে এমন কোনো হাতিয়ার দেওয়া যাবে না, যাতে জনগণকে তারা জিম্মি করে ফেলে।

সালাহউদ্দিন আহমদ
সালাহউদ্দিন আহমদ
প্রশ্ন : প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাতে নিরপেক্ষ ব্যক্তি নিয়োগ হয়। তাদের কর্মপদ্ধতি আইনে থাকতে পারে, মূল বিষয়টা ছিল নিয়োগের পদ্ধতি।

সালাহউদ্দিন আহমদ: হ্যাঁ, যদি এই নিয়োগ কমিটির বিষয়টা আমরা আইনের মাধ্যমে করি, অসুবিধা কী? তাহলে পরে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর প্রসেসের মধ্য দিয়ে যদি সংশোধন করতে হয়, সেই অপশনটা থাকবে। আর যদি এটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করি, তাহলে বারবার সংবিধান সংশোধন করার মতো সুযোগ থাকবে না। আর বাংলাদেশের এক্সপেরিয়েন্স কী? কোনো সংস্থাকে যদি আমরা এমনভাবে স্বাধীনতা দিই, সেই স্বাধীনতা যদি পরে অপপ্রয়োগ করে জনগণের ওপরে, যেটা আমরা দুদকের ক্ষেত্রে দেখেছি। তাহলে পরে সেটা সংশোধনের আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

প্রশ্ন : গত ১৫ বছর সবাই সমালোচনা করেছে যে আওয়ামী লীগ সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ করেছিল। যেমন নির্বাচন কমিশন, পিএসসি, দুদক। এখন এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পদ্ধতিটা পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। আপনারা সেখানে আপত্তি দিচ্ছেন। তার মানে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ওই দলীয়করণটাই হয়তো আবার হবে?

সালাহউদ্দিন আহমদ: রাষ্ট্রের ব্যারাম বা অসুখটা কিন্তু সেই জায়গায় নয়। রাষ্ট্রের যে অসুস্থতা এসেছিল সাংবিধানিকভাবে, সেই জায়গাটা হচ্ছে কেয়ারটেকার সরকার ছিল না, স্বাধীন জুডিশিয়ারি ছিল না। দলীয়করণ করা হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনতা ভোগ করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা অধীন হয়ে গিয়েছিল নির্বাহী বিভাগের। রাষ্ট্রের অস্বচ্ছতা ছিল, ফ্রিডম অব প্রেস ছিল না। বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং কেয়ারটেকার সরকারের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা হলে রাষ্ট্রে আর কোনো সাংবিধানিক অথবা সংসদীয় একনায়কতান্ত্রিক অবস্থা সৃষ্টি হবে না; বা ব্যক্তি স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থা সৃষ্টি হবে না। শুধু নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করার মধ্য দিয়ে একটি সত্যিকারের কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে না।

প্রশ্ন : মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল ও আইন কমিশনে রাষ্ট্রপতি সরাসরি নিয়োগ দেবেন, এতে আপনারা একমত হলেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সেনাপ্রধান, ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের মহাপরিচালক ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে আপনাদের আপত্তি কেন?

সালাহউদ্দিন আহমদ: তিন বাহিনীর প্রধানের বিষয়টি আমাদের টেবিলে আসেনি। আলোচনার ক্ষেত্রে এসেছে ছয়টা বিষয়। ছয়টার মধ্যে আমরা চারটাতে রাজি হয়ে বাকি দুইটাতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি।

যুক্তিটা হচ্ছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে যদি স্বাধীনতা দেওয়া হয়, এভাবে যদি কোনো সময় নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন যায় যে বিদ্যুতের ইউনিট প্রাইস ৫০ টাকা করে দিল, তখন তো নির্বাহী বিভাগ আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন যেহেতু পাবলিক হিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এ সমস্ত রেট ঠিক করে। এখানে কমিশন রাষ্ট্রপতি যদি ইনডিপেনডেন্টলি হ্যান্ডল করেন, দায়িত্বটা তো নির্বাহী বিভাগের। অথচ অথরিটি থাকবে রাষ্ট্রপতির। সেটা একটু সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।

সালাহউদ্দিন আহমদ
সালাহউদ্দিন আহমদ
প্রশ্ন : তার মানে আপনাদের ওই আশঙ্কা রয়ে গেছে যে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে দাঁড়ালে সরকার সমস্যায় পড়বে?

সালাহউদ্দিন আহমদ: বাংলাদেশের এনার্জি এবং পাওয়ার সেক্টরে এখন পর্যন্ত যে সংকট অবস্থা, সেই সংকট অবস্থাকে সামনে রেখেই এই চিন্তাটা করছি। যদি এমন হতো যে আমাদের দেশে কোনো পাওয়ারের ক্রাইসিস নেই, বিদ্যুতের ক্রাইসিস নেই, তখন আমরা অন্যভাবে চিন্তা করতে পারতাম। আমাদের প্রস্তাব হলো, জাতীয় সংসদে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতের জন্য যেভাবে আইন প্রণয়ন করা দরকার, সেটা সেখানে করি। শুধু একজন গভর্নর নিয়োগ হয়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেটরি অবস্থা কিন্তু পরিবর্তন হবে না।

প্রশ্ন : সমালোচকেরা যদি বলে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ক্ষেত্রে দলীয় লোক বসানো বা এটার পেছনে দুর্নীতি অনেক কিছুই থাকতে পারে।

সালাহউদ্দিন আহমদ: যদি গভর্নরের ক্ষেত্রে বলি, আপনাদের বক্তব্যটা খুবই সংগত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে যদি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে পরিচালনা করতে চাই, করতে পারি। তাহলে এ সমস্যাটা আর থাকে না। কিন্তু সেখানে আইন পরিবর্তন না করে শুধু নিয়োগের ক্ষমতাটা রাষ্ট্রপতিকে দিলে সঠিক হবে না। কারণ, দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা যে অবস্থায় এখন আছে, সেই অবস্থার পরিবর্তন চায় মানুষ।

আমাদের প্রস্তাব হলো, জাতীয় সংসদে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতের জন্য যেভাবে আইন প্রণয়ন করা দরকার, সেটা সেখানে করি। শুধু একজন গভর্নর নিয়োগ হয়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেটরি অবস্থা কিন্তু পরিবর্তন হবে না।

প্রশ্ন : রাষ্ট্রের কিছু জায়গায় দলীয় নিয়োগের ফলটা অতীতে ভালো হয়নি। তিন বাহিনীর প্রধান, ডিজিএফআই, এনএসআই, এই বিভিন্ন সংস্থার প্রধান দলীয় নিয়োগে, এই চর্চাটা অনেকেরই ধারণা যে আপনারাও ভবিষ্যতে করবেন।

সালাহউদ্দিন আহমদ: আমি অনেক আগেই বলেছি, রাষ্ট্রের ব্যারামটা কিন্তু এই জায়গায় নয়। রাষ্ট্রের ব্যারামটা হচ্ছে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং কেয়ারটেকারের অধীনে নির্বাচন, স্বাধীন জুডিশিয়ারি এবং ফ্রিডম অব প্রেস।

নির্বাহী বিভাগকে যদি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়, তার যদি সব জায়গায় হাত-পা বাঁধা থাকে এবং অন্যান্য অঙ্গ যদি তার সাংবিধানিক এখতিয়ারের মধ্যে কাজ করতে পারে; শুধু নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক এখতিয়ার না থাকে, তাহলে একটা অকার্যকর পঙ্গু এবং দুর্বল নির্বাহী বিভাগ দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে হবে।

প্রশ্ন : তার মানে আপনারা মনে করেন যে সরকার চালানোর জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আপনাদের মতের বা আপনাদের সুবিধা হয়, এমন লোক দরকার?

সালাহউদ্দিন আহমদ: এগুলো সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কে বলল? সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন একটা আছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কন্ট্রোলার, অ্যাটর্নি জেনারেল আছে। এটা নিয়ে কি কোনো দিন কোনো কোয়েশ্চেন হয়েছে? হয়নি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ন্যায়পাল আছে, কোনো দিন গঠিত হয়নি। আমরা বললাম, ন্যায়পাল আমরা গঠন করব, আইনটা আরও সংস্কার করে এবং শক্তিশালী করে করা হবে। কিন্তু অন্যান্য যেসব নিয়োগের কথা বলেন, এগুলো তো সংবিধানের কোনো প্রতিষ্ঠান নয় এমনকি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান নয়। নির্বাহী বিভাগকে যদি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়, তার যদি সব জায়গায় হাত-পা বাঁধা থাকে এবং অন্যান্য অঙ্গ যদি তার সাংবিধানিক এখতিয়ারের মধ্যে কাজ করতে পারে; শুধু নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক এখতিয়ার না থাকে, তাহলে একটা অকার্যকর পঙ্গু এবং দুর্বল নির্বাহী বিভাগ দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে হবে।

সালাহউদ্দিন আহমদ
সালাহউদ্দিন আহম
প্রশ্ন : আপনারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলছেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের দুজনের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে আপনারা। দুজনের মধ্যে একজনকে প্রধান বিচারপতি করার বিধান করা হলে, বিচারপতিদের মধ্যে দলীয় আনুগত্য চর্চা বেড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেক দল ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় প্রকাশ করেছে।

সালাহউদ্দিন আহমদ: প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা একটা অপশন রাখতে চাই এই জন্য যে আমাদের বিগত দিনের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। যদি সিনিয়র মোস্টকে একমাত্র চয়েস হিসেবে রাখা হয়, যদি সেই ব্যক্তির সম্পর্কে ভাবমূর্তি এমন থাকে যে তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়া সমীচীন হবে না। অন্তত এই একটা বিধান থাকা উচিত।

প্রশ্ন : দুজনের ক্ষেত্রেও তো এটা হতে পারে।

সালাহউদ্দিন: দুজনের ক্ষেত্রে হতে পারে কিন্তু তারপর একটা সুযোগ থাকবে। এখানে নির্বাহী বিভাগের কোনো সুপারিশের বিষয় নেই। এটা সাংবিধানিক একটা বিধান যেটা রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতি বা বিচার বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যে আইনগুলো আমরা সামনে প্রণয়ন করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার মধ্যে দিয়ে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের ভেতরে যদি এই প্র্যাকটিসটা চালু রাখতে পারি, তাহলে আর দলীয় কোনো বিচারপতি এই জুডিশিয়ারিতে থাকবে না। সেই ক্ষেত্রে ১৫ বছর পরে, ২০ বছর পরে হয়তো আমরা এই বিধানটা একটাতে ফিক্সড করতে পারব। যদি সিনিয়র মোস্টকে একমাত্র চয়েস হিসেবে রাখা হয়, যদি সেই ব্যক্তির সম্পর্কে ভাবমূর্তি এমন থাকে যে তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়া সমীচীন হবে না। অন্তত এই একটা বিধান থাকা উচিত।

প্রশ্ন : ঐকমত্য কমিশন বলেছে, নোট অব ডিসেন্টের যেমন গুরুত্ব আছে, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতামতেরও একটা গুরুত্ব আছে। এটাও বিবেচনায় নিতে হবে। আপনারা এটা কীভাবে দেখেন?

সালাহউদ্দিন আহমদ: আমি দেখি ২৭টা দল কারা এবং ২৭টার বাইরে কারা—এভাবে দেখি। জনগণের প্রতিনিধিত্ব, জনগণের মধ্যে কারা কত অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, আমি সেভাবে দেখি এবং তাদের পার্লামেন্টে অংশটা কতটুকু থাকবে, সেভাবে দেখি। এর বেশি আমি খোলাসা করে বলতে চাই না। নাম্বার অব পার্টিজ বেশি হলেই এই যে সেটা সংখ্যাধিক্য পাবে জনগণের মধ্যে, সেটা ঠিক না। আমরা যদি ৩৬টা দল ওখানে যাই, ৩২টা দলের সঙ্গে আলাপ হয়ে, সব দল মিলে বাংলাদেশের সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করি, এটা যদি আমরা দাবি করি, তাহলে এটা হবে একটা গ্রামারেটিকেলি মিসটেক। কারণ, বাংলাদেশের সব মানুষ তো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। বলা যায় ফ্লোটিং ভোট কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ পার্সেন্ট।

প্রশ্ন : আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করলেন, তাহলে কি এটাকে আমরা জাতীয় ঐকমত্য বলতে পারব?

সালাহউদ্দিন আহমদ: যেহেতু অনেকগুলো দল এখানে নেই। দিস ইজ মোস্ট ভ্যালিড কোয়েশ্চেন। আমরা যদি ৩৬টা দল ওখানে যাই, ৩২টা দলের সঙ্গে আলাপ হয়ে, সব দল মিলে বাংলাদেশের সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করি, এটা যদি আমরা দাবি করি, তাহলে এটা হবে একটা গ্রামারেটিকেলি মিসটেক। কারণ, বাংলাদেশের সব মানুষ তো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। বলা যায় ফ্লোটিং ভোট কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ পার্সেন্ট। তারা তো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়, তারা একটি দলকে সমর্থন তখন করে, যখন ভোট দিতে যায়। সুতরাং আমরা যদি মনে করি এই রাজনৈতিক দলগুলো, আমরা শতভাগ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করি, এটা সঠিক নয়।

প্রশ্ন : জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রথম দফায় বলা হয়েছিল যেগুলোতে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো গণভোটে যাওয়া যায়। গণভোট হলে সাধারণ মানুষ কী বলল তাহলে একটা বড় অংশের মতামতটা পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কী বলবেন?

সালাহউদ্দিন আহমদ: গণভোট কখন হয়? আমাদের সংবিধান অনুসারে, গণভোট হবে কয়েকটা প্রভিশনে। এ ছাড়া যদি জাতীয় ভিত্তিতে সবাই ঐকমত্য হয় যে কোনো বিষয়ে গণভোট হবে, সেটা এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল প্রভিশন হবে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতে পারে। কিন্তু সেই বিষয়টা তো হবে একটা বা দুইটা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে। এই অসংখ্য সংস্কার প্রস্তাব বিষয় নিয়ে কি কোনো গণভোট হওয়া সম্ভব হবে? এখানে তো ৮৫টা দফা হবে, ১০০টা দফা হবে, সেটা জনগণের কাছে আমরা কীভাবে নিয়ে যাব?

প্রশ্ন : তাহলে এখন যে ঐকমত্য হচ্ছে, সেটা কী?

সালাহউদ্দিন আহমদ: সংস্কার নিয়ে এই যে ঐকমত্য হচ্ছে, এটা হচ্ছে জাতীয় রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল। যারাই পার্লামেন্টে যাবে, তাদের এটা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো সবাইকে মেনে নিতে হবে। বাস্তবায়নের পদ্ধতি আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে খুঁজে বের করা যাবে। কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য তো একটা বৈধ ফোরাম লাগবে এবং সেই বৈধ ফোরাম জাতীয় সংসদ।

জুলাই জাতীয় সনদের যে খসড়া গত ২৭ জুলাই আমাদের সবার কাছে পাঠিয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বক্তৃতাতেও বলা হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার মধ্য দিয়ে যেসব প্রস্তাবনা, সুপারিশ প্রণয়ন করা হবে, সেই অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়িত হবে পরবর্তী নির্বাচিত জাতীয় সংসদে। জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত হয়ে আমাদের মতামত জমা দিয়েছি।

কিন্তু ৩১ জুলাই যেদিন দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শেষ হবে, সেদিন দু–একটা দল থেকে আপত্তি ওঠানো হলো, বলা হলো এগুলো বাস্তবায়নের জন্য কোনো আইনি ভিত্তি যদি না দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা স্বাক্ষর করবেন কি না ভাববেন। তখন আমাদের প্রস্তাব ছিল, এই বিষয়ে যদি আইনি কোনো প্রক্রিয়া বের করার জন্য কোনো আলোচনার আহ্বান করেন, আমরা অংশ নেব।

এখন আইনে কী বৈধ প্রক্রিয়া বের করা যাবে, সেটা তো আলাপ-আলোচনা এখনো হয়নি। কিন্তু অঙ্গীকারনামা নামে যে সংশোধিত  খসড়া দেওয়া হলো, সেই অঙ্গীকারনামায় কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আসলে অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য। এই ধারণাটা ৩১ দফাতে আমরা যখন দিয়েছিলাম, ধারণা হলো এই, যদি আমরা আপার হাউসে বিভিন্ন সেক্টরে যারা প্রথিতযশা মানুষ, মেধাবী সন্তানদের এই জায়গায় স্থান দিতে পারি, তাহলে জাতি উপকৃত হবে। অথচ তাদের যদি আমরা সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দিই, তারা হয়তো জয়ী হয়ে আসতে পারবে না। সে জন্য ৩১ দফায় আমরা এটা প্রস্তাব করেছিলাম।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে

প্রশ্ন : আমরা একটু প্রসঙ্গ পাল্টাই। আপনারা রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের ৩১ দফায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলেছেন। কমিশনের আলোচনায়, দলীয় প্রস্তাবনায় আপনারা নিম্নকক্ষে আসন অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের কথা বলেছেন। অনেকেই বলছেন, এভাবে উচ্চকক্ষ গঠন করা হলে সেটা হবে নিম্নকক্ষের প্রতিলিপি। এটা করে রাষ্ট্রের টাকা খরচ ছাড়া আর কী হবে?

সালাহউদ্দিন আহমদ: এই ধারণাটা ৩১ দফাতে আমরা যখন দিয়েছিলাম, ধারণা হলো এই, যদি আমরা আপার হাউসে বিভিন্ন সেক্টরে যারা প্রথিতযশা মানুষ, মেধাবী সন্তানদের এই জায়গায় স্থান দিতে পারি, তাহলে জাতি উপকৃত হবে। অথচ তাদের যদি আমরা সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দিই, তারা হয়তো জয়ী হয়ে আসতে পারবে না। সে জন্য ৩১ দফায় আমরা এটা প্রস্তাব করেছিলাম।

সালাহউদ্দিন আহমদ: আমরা তো ভারসাম্যের আইডিয়া থেকে উচ্চকক্ষের প্রস্তাব করিনি। কারণ, একটা ইনডাইরেক্টলি নির্বাচিত অথবা অনির্বাচিত উচ্চ কক্ষ হলে সেখানে আমরা সমস্ত এখতিয়ার তো দেব না।

প্রশ্ন : তাহলে এটা করে লাভ কী?

সালাহউদ্দিন: এটা অনেক একটা এ রকম যে জাতীয়ভাবে যারা মেধাবী, বিভিন্ন সেক্টরে যাদের অবদান আছে, তাদের জাতি বিনির্মাণে জাতি গঠনে কাজে লাগানো। তাদের পরামর্শ এবং তাদের চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগানো। তারা অ্যাডভাইস করবে লোয়ার হাউসে। আর তারা যদি কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতে চায়, নতুন আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রের জন্য, জনগণের জন্য, সেটা তারা পরামর্শ দেবে।

প্রশ্ন : সংরক্ষিত নারী আসন ১০০–তে উন্নীত করা এবং সরাসরি ভোট—এই প্রস্তাবে ঐকমত্য হলো না। বিএনপি–জামায়াতসহ প্রায় সব দল এ ক্ষেত্রে এক হয়ে গেল, এর কারণ কী?

সালাহউদ্দিন আহমদ: দুই–একটা দল ছিল, ছোট দল, যাদের সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে মত ছিল। কোন ১০০টি নির্বাচনী এলাকা নির্ধারিত হবে, এগুলো নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়ে কোনো সলিউশন আসা যায়নি। আর বদিউল আলম মজুমদার সাহেব ঘূর্ণমান পদ্ধতির কথা বলেছেন। যেটা পৃথিবীর কোনো দেশে খুব একটা কার্যকর হয়নি।
রোটেশন পদ্ধতিতে সেই এলাকার মানুষের কোনো পছন্দ থাকবে না। তাকে আমরা বাধ্য করব যে তোমাকে এই নারী আসনে নারী সদস্য নিতে হবে। কিন্তু সেই এলাকার মানুষের একটা ডেমোক্রেটিক রাইট আছে তো যে ঠিক আছে এখানে নারীও থাকুক, পুরুষও থাকুক। আমরা যাকে পছন্দ করব, তাকে ভোট দেব। সেই অপশনটা রাখা হচ্ছে না। সে জন্য এই পদ্ধতি রিজেক্টেড হয়ে গেল।

আমি প্রস্তাব করেছিলাম যে আমরা সরাসরি নির্বাচনের বিধানটা এখন থেকে চালু করি, তবে সীমিত আকারে। এখন সংবিধান সংশোধনের অবস্থা নেই। এখন এই যে নির্বাচনটা হবে, এখানে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান করি, সরাসরি আসনগুলোর মধ্যে ৫ শতাংশ নারীদের দিতে হবে। তবে ৫০ আসন রিজার্ভ রাখতে হবে। কারণ, ওগুলো না রাখলে দেখা যাবে যে নারীরা আর পার্লামেন্টে নেই।

এবার আমরা শুরু করলাম, তারপরের পার্লামেন্টে আবার ৫ থেকে ১০ পারসেন্টে যাবে সেই বিধানটা এখানে আছে। এইভাবে নারীদের ওয়ান থার্ড পর্যন্ত যখনই পূর্ণ হবে, তখন সেই বিধানটা আর লাগবে না। তখন আমরা ওই সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আসন নির্ধারণ করে দেওয়া বা অন্য কিছু আমরা তখন ভাবতে পারব। আমাদের মতো দলেও খুব বেশি পাওয়া যাবে না। অন্যান্য দলের ক্ষেত্রে তো আরও ক্রাইসিস। কারণ, আমাদের সামাজিক অগ্রগতি, নারী সমাজের অগ্রগতি এখনো ওই পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। সে জন্য আমাদের প্রস্তাবটা হচ্ছে, আমরা সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য এখন শুরু করি। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যাবে যে তারা প্রস্তুত সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য।

প্রশ্ন : সরাসরি আসনে মনোনয়ন দেওয়ার মতো নারী প্রার্থী বিএনপিতে কত আছে?

সালাহউদ্দিন: আমাদের মতো দলেও খুব বেশি পাওয়া যাবে না। অন্যান্য দলের ক্ষেত্রে তো আরও ক্রাইসিস। কারণ, আমাদের সামাজিক অগ্রগতি, নারী সমাজের অগ্রগতি এখনো ওই পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। সে জন্য আমাদের প্রস্তাবটা হচ্ছে, আমরা সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য এখন শুরু করি। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যাবে যে তারা প্রস্তুত সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য। কিন্তু ওভার নাইট এটা করা সম্ভব হবে না।

প্রশ্ন : জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী?

সালাহউদ্দিন আহমদ: জামায়াতে ইসলামী এ দেশে একটা রাজনৈতিক দল। কয়েকবার পার্লামেন্টে ছিল। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস ও আলাদা আদর্শ আছে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমরা একসময় নির্বাচনী জোট করেছি। ওটা কৌশলগত, কোনো আদর্শিক জোট না। এখনো তারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন–সংগ্রামে যে অবদান রেখেছে, সেটাকে আমরা স্বীকার করি। ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক চর্চায় তারা অংশগ্রহণ করবে, সামনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, সেটা আমরা মনে করি।

প্রশ্ন : আপনাদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিন রাজনৈতিক জোট ছিল বা আপনার রাজনৈতিক মিত্র ছিল। সামনে আবার এই ধরনের কিছু হওয়ার কোনো সুযোগ আছে?

সালাহউদ্দিন আহমদ: আমরা তো এই বক্তব্য আরও অনেক আগেই দিয়েছি যে সামনের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমাদের জোটবদ্ধ ইলেকশন করার কোনো সম্ভাবনা নেই। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমরা একসময় নির্বাচনী জোট করেছি। ওটা কৌশলগত, কোনো আদর্শিক জোট না। এখনো তারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন–সংগ্রামে যে অবদান রেখেছে, সেটাকে আমরা স্বীকার করি। ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক চর্চায় তারা অংশগ্রহণ করবে, সামনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, সেটা আমরা মনে করি।

প্রশ্ন : কিন্তু আপনারা তো অন্য ইসলামি দলগুলোর নৈকট্যলাভের চেষ্টা করছেন?

সালাহউদ্দিন আহমদ: হ্যাঁ। বাংলাদেশে ৯০ থেকে ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান। এখানে সবাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। কিন্তু তারা সবাই ধর্মভীরু মানুষ। তাদের অধিকাংশের ধর্মীয় প্রতিনিধিত্বটা করে এ দেশের আলেম সমাজ এবং তাদের মধ্যে কিছু কিছু আছে ইসলামিক দল করেছে। তাদের সঙ্গে আমাদের আগেও যোগাযোগ ছিল। এখনো যদি আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা অবদান রেখেছে, সেই রকম ইসলামি দলের সঙ্গে জোট করি, সেটা আমাদের চিন্তায় আছে।

বাংলাদেশের যারা ধর্মীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, হেফাজতে ইসলামের সম্মানিত আমির আল্লামা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, ওনার সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করেছি। এ ছাড়া যাঁরা এই বাংলাদেশে ইসলামি প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসা শ্রেণি সৃষ্টি এবং মানুষের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য অবদান রেখেছেন, যেমন শর্ষিনার পীর সাহেব, ওনার সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করেছি। আমাদের মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও শর্ষিনার পীর সাহেবের সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছিলেন। আমরা জমিয়তুল মুদাররেছিনের সঙ্গে সভা করেছি। মাদ্রাসাশিক্ষার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা এবং তারা একটা বিশাল সংগঠন। এভাবে আমরা জনগণের মধ্যে একটা বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি করতে চাই। এখনো যদি আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা অবদান রেখেছে, সেই রকম ইসলামি দলের সঙ্গে জোট করি, সেটা আমাদের চিন্তায় আছে।

প্রশ্ন : বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে ইসলামপন্থীদের আনুকূল্য নিয়েই বিএনপিকে চলতে হবে। আপনি কি এটা মানেন?

সালাহউদ্দিন আহমদ: আরেকটি রাজনৈতিক দলের নেতা কি বললেন, সেটার ওপরে মন্তব্য করতে আমি অভ্যস্ত নই। আমরা হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়েছিলাম। মুরব্বিদের সঙ্গে দেখা করেছি, প্রিন্সিপালের সঙ্গে এবং মহাপরিচালকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আল্লামা শফী সাহেবের কবর জিয়ারত করেছি, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর কবর জিয়ারত করেছি।

ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করতে পারিনি, কিন্তু আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। যখনই সময় হয়েছে আমরা এটার স্বীকৃতিস্বরূপ সেখানে গিয়েছি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, একটা জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু যে রাজনৈতিক বক্তব্যের কথা আপনি বললেন, সেটার সঙ্গে আমি এটাকে মেলাতে চাই না। কারণ, আনুকূল্য নেওয়ার বিষয় নয় এটা। এটা হচ্ছে আমরা ইসলামি মূল্যবোধকে ধারণ করে রাজনীতি করি।

প্রশ্ন : সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে অভিযোগ তোলা হচ্ছে যে লন্ডন বৈঠকের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপির স্বার্থে বা পরামর্শে চলছে। প্রশাসনে বিএনপির লোকদের প্রভাব। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে কি সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হবে?

সালাহউদ্দিন আহমদ: কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে এ রকম অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, আমরা শুনেছি। কিন্তু লন্ডনে আমাদের নেতা তারেক রহমান অবস্থান করছেন। এখানে প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন সফরের সময় স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতা, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের যে নেতৃত্বদানকারী, তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন; এটাই তো স্বাভাবিক। সেখানে রাজনৈতিক আলাপ হবে, এটাও স্বাভাবিক। আমাদের দাবি অনুসারে নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু ৫২টা রাজনৈতিক দলের একই দাবি ছিল। এমনকি যারা আপত্তি তুলেছে, তাদেরও দাবি ছিল যে নির্বাচন রোজার আগে হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।

প্রশ্ন : প্রশ্নটা উঠছে এই জন্য যে জুলাই ঘোষণাপত্র যেটা প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করলেন, এটা চূড়ান্ত করা হয়েছে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে। অন্যদের শেষ মুহূর্তে জানানো হয়েছে।

সালাহউদ্দিন আহমদ: এটা প্রধান উপদেষ্টাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, কাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, কোন সময় আলোচনা হয়েছে। হ্যাঁ, আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, আমাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। আমরা মতামত দিয়েছি, এটুকু সত্য। তবে শুধু বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে এটা প্রণয়ন করা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর উনি দিতে পারবেন।

প্রশ্ন : লন্ডন বৈঠকে কি বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সমঝোতা হয়েছে?

সালাহউদ্দিন আহমদ: এটা সমঝোতা নয়, আলাপ-আলোচনা হয়েছে। লন্ডন বৈঠকে আমরা নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেছিলাম এবং নির্বাচনের সময়সীমা কেন যৌক্তিকভাবে এগিয়ে নিয়ে আসা দরকার। আমাদের দাবি ছিল, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি ছিল ডিসেম্বর ২০২৫–এর মধ্যে নির্বাচন হোক। কিন্তু কোনো না কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টা মনে করলেন ডিসেম্বরের ভেতরে দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা বলেছি, বিলম্বিত হলেও সেটা রোজার পরে যাওয়াটা সমীচীন হবে না। সেটা তিনি যুক্তিসংগত মনে করেছেন, মেনে নিয়েছেন।

প্রশ্ন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সালাহউদ্দিন আহমদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *