নাতাশা ছিলেন সবার দৃষ্টিতে এক আদর্শ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সারির ছাত্রী, অফিসে নির্ভরযোগ্য কর্মী, পরিবারে দায়িত্বশীল মেয়ে। তার কাজের প্রতি নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, আর নিখুঁত পরিকল্পনা দেখে সবাই বলত, ‘তুমি তো সবকিছু অনেক সুন্দরভাবে সামলাও!’ নাতাশা হাসতেন, মাথা নেড়ে বলতেন, ‘করতে হলে ভালোভাবে করব, নয়তো করবই না।’
কিন্তু এই নিখুঁতটার আড়ালে ছিল এক অদৃশ্য চাপ। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার মাথায় ঘুরতে থাকত – আজকে কি সব কাজ ঠিকঠাক ভাবে করতে পারব আমি? যদি ঠিকঠাক না হয় তাহলে কী হবে? যদি কেউ খুশি না হয়? যদি ভুল হয়? এই চিন্তাগুলো তাকে এতটাই গ্রাস করেছিল যে তিনি ধীরে ধীরে ঘুম হারাতে শুরু করলেন। মাথাব্যথা, ক্লান্তি, আর এক ধরনের অস্থিরতা তার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠল।
এরপর একদিন অফিসে একটি ছোট ভুল করে বসেন নাতাশা। বস কিছু বলেননি, সহকর্মীরাও হাসিমুখেই বিষয়টি সামলে নেন। কিন্তু নাতাশা নিজেকে ক্ষমা করতে পারলেন না। রাতে ডায়েরিতে লিখলেন, ‘আমি ব্যর্থ। আমি যথেষ্ট ভালো না। আমাকে দিয়ে কোন কিছুই পারফেক্ট ভাবে হবে না।’
এ ঘটনার পর নাতাশা একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান। সেখানেই তিনি প্রথমবার শুনলেন – পারেফেকশনিজমের দুই রূপ আছে। একদিকে স্বাস্থ্যকর পারফেকশনিজম, যা মানুষকে উন্নতির পথে নিয়ে দেয়। অন্যদিকে ক্ষতিকর পারফেকশনিজম, যা মানুষকে আত্মসমালোচনার ফাঁদে ফেলে দেয়। তখন নাতাশা বুঝতে পারলেন, তিনি দ্বিতীয়টির শিকার।
সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে বললেন, ‘তুমি নিজের প্রতি কঠোর কেন? প্রত্যেক মানুষই ভুল করে। ভুল তো শেখারই অংশ। ব্যর্থতা মানেই তুমি ব্যর্থ নও।’
নাতাশা ধীরে ধীরে শিখতে শুরু করলেন সব কাজ নিখুঁত হতে হবে না। ভালো কাজও মূল্যবান। তিনি নিজের কাজগুলো ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিতে শুরু করলেন। একেকটি কাজ শেষ হলে নিজেকে বাহবা দিতেন তিনি।
এই অভিজ্ঞতা শুধু নাতাশার নয় – গবেষণাও বলছে, পারফেকশনিজম মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকিয়াট্রি- এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিক্ষার্থী নিজেদের উচ্চ মানদণ্ড পূরণ করতে না পারার অনুভূতিতে ভোগেন, তাদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ এবং মানসিক চাপের মাত্রা অনেক বেশি।
এছাড়াও মনোবিজ্ঞানী পল হিউইট ও গর্ডন ফ্লেট পারফেকশনিজমকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন:
তাদের মতে, পারফেকশনিজম মানে শুধু উন্নতির চেষ্টা নয়, বরং নিজের প্রতি কঠোরতা, যা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ায়।
এরপর একদিন নাতাশা তার এক বন্ধুর সাফল্য দেখে হঠাৎ নিজেকে ছোট মনে করলেন। কিন্তু এবার নিজেকে থামালেন। ডায়েরি খুলে লিখলেন, ‘আমি গত মাসে তিনটি বড় কাজ শেষ করেছি। আমি এগিয়ে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আমি পারব নিজেকে ঠিক করতে। পারব একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে।’
নাতাশা এখন জানেন, নিখুঁত হওয়ার চেয়ে মানবিক হওয়াটা বেশি জরুরি। তিনি ব্যর্থতাকে এখন আর ভয় পান না, বরং শেখার সুযোগ হিসেবে দেখেন। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তিনি আগের মতো কঠোর নন। প্রিয়জনের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন, নিখুঁত সংযোগ নয় – খাটি সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
এখন নাতাশা হয়তো আগের মতো ‘পারফেক্ট’ নয়, কিন্তু অনেক বেশি শান্ত। তার গল্প আমাদের শেখায় – নিখুঁত হওয়ার চেষ্টায় যদি নিজেকে হারিয়ে ফেলি, তবে সেই নিখুঁতটা আর সাফল্য নয়, বরং এক অদৃশ্য বন্দিত্ব। মুক্তি আসে তখনই, যখন আমরা ইম্পারফেকশন্স-কে গ্রহণ করতে শিখি।
তথ্য সূত্র: হার্ভার্ড সামার স্কুল, ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকিয়াট্রি, মেডিকেল নিউজ টুডে