মার্কিন প্রেসিডেন্টের নোবেল খায়েশ ও মোদির সঙ্গে একটি তিক্ত ফোনালাপ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর ধীরে ধীরে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত জুনে একটি ফোনালাপের মধ্য দিয়ে মোদির মধ্যে এই ধৈর্যচ্যুতির সূচনা হয়, যা পরে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ট্রাম্প প্রকাশ্যে ও কিছুটা উল্লসিতভাবে বারবার বলে আসছিলেন, গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে সংঘাত শুরু হয়েছিল, তা সমাধানে তিনি ‘মধ্যস্থতা’ করেছেন। প্রতিবেশী এ দুই দেশের মধ্যে এই ধরনের সংঘাতের ইতিহাস ৭৫ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো। ট্রাম্প এই সংঘাত নিয়ে যা বলছিলেন, বাস্তবতা তার তুলনায় অনেক বেশি গভীর ও জটিল।

গত ১৭ জুন মোদির সঙ্গে এক ফোনালাপে প্রসঙ্গটি আবারও টেনে আনেন ট্রাম্প। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা শেষ করতে পারায় তিনি কতটা গর্বিত, সেদিনের ফোনালাপে ট্রাম্প তা মোদিকে জানান।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ–ও জানান, পাকিস্তান তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিতে যাচ্ছে। বিষয়টি তিনি নিজের জন্য সম্মানজনক হিসেবে দেখছেন। কারণ, নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্প নিজেই প্রচার চালাচ্ছিলেন।

ট্রাম্প-মোদির ১৭ জুনের ফোনালাপের বিষয়ে জানেন—এমন কর্মকর্তাদের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীরও (পাকিস্তানের মতো) একই ধরনের কাজ করা উচিত। তাই আলাপে তিনি মোদিকে এমনটা করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। মোদি একসময় ট্রাম্পকে ‘সত্যিকারের বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

ট্রাম্পের ইঙ্গিতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি ট্রাম্পকে বলেছিলেন, সাম্প্রতিক অস্ত্রবিরতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নেই। ভারত ও পাকিস্তানই তা সরাসরি সমাধান করেছে।

কিন্তু ট্রাম্প মোটাদাগে মোদির দাবি অগ্রাহ্য করেন। কিন্তু এই মতানৈক্য ও ট্রাম্পের নোবেল পুরস্কার মনোনয়নের বিষয়ে মোদির অনীহা, তাঁদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২১) মোদির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল।

মোদি-ট্রাম্পের মধ্যে এমন এক সময়ে এই মতবিরোধ দেখা দিল, যখন দেশ দুটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য আলোচনা চলছিল। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সেই বাণিজ্য আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। গত ২৭ আগস্ট থেকে ভারতের পণ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়েছে।

সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে চীন সফর করেছেন মোদি। দুই দিনের ওই সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ ২০টির বেশি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান যোগ দিয়েছেন।

নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণটি তৈরি করতে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির প্রায় ২০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। আলোচ্য বিষয়ের ফলাফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে এসব কর্মকর্তার কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

দুই নেতার মধ্যে জুনে ফোনে আলোচনার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ট্রাম্প আচমকা ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এর কয়েক দিন পর রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল রপ্তানির অভিযোগে জরিমানা হিসেবে ভারতের ওপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন।

মোদি একসময় ট্রাম্পকে ‘সত্যিকারের বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

চীনের তিয়ানজিনে সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনের ফাঁকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ৩১ আগস্ট ২০২৫
চীনের তিয়ানজিনে সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনের ফাঁকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ৩১ আগস্ট ২০২৫

জুনে ফোনে আলাপকালে ট্রাম্প মোদিকে জানিয়েছিলেন, চলতি বছরের শেষে ভারতে অনুষ্ঠেয় কোয়াডের শীর্ষ সম্মেলনে তিনি অংশ নেবেন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফরসূচি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কর্মকর্তাদের মতে, শরতে ট্রাম্পের ভারতে আসার কোনো পরিকল্পনা নেই। ইতিমধ্যে তিনি ভারত সফর বাতিলের ঘোষণাও দিয়েছেন।

ভারতের কোনো কোনো মহল এখন ট্রাম্পকে জাতীয় অপমান বলে মনে করছেন। গত সপ্তাহে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের এক উৎসবে ট্রাম্পের একটি বিশাল পুতুল দেখা যায়, যেখানে তাঁকে ‘পিঠে ছুরিকাঘাতকারী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের এক কর্মকর্তা তো ট্রাম্পের আচরণকে ‘গুন্ডাগারদি’ বলে মন্তব্য করেছেন। গুন্ডাগারদি বলতে সরাসরি হয়রানি বা দস্যুবৃত্তি বোঝায়।

১৭ জুন ফোনে আলাপের পর ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে এখন পর্যন্ত আর কথা হয়নি। এই দুই নেতার সম্পর্কের শীতলযুদ্ধের সারমর্ম হলো—ট্রাম্প ও মোদি দুজনই তেজস্বী নেতা। দুজনই জনতুষ্টবাদী বা সস্তাভাবে জনগণের মন জয় করতে মরিয়া। এই ধরনের নেতারা অহংকারী হন এবং তাঁদের মধ্যে স্বৈরশাসকের প্রবণতা থাকে। মোদি ও ট্রাম্পের মধ্যেও তা–ই আছে।

একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নোবেল পুরস্কার জয়ের জন্য কতটা ঝুঁকি নিতে পারেন, এ গল্প তার একটি আলেখ্য হয়ে থাকবে। পাশাপাশি পাকিস্তান প্রসঙ্গের কারণে ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী নিজেদের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারের সঙ্গেও সম্পর্ককে কতটা ঝুঁকিতে ফেলতে পারেন—এ গল্প সেটারও একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *