মন ও মস্তিষ্কের ১২টি গোপন সত্য, আপনি কয়টা মানেন?

মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. প্যাট্রিসিয়া শ্মিড মানব মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করছেন দুই দশকের বেশি সময় ধরে। সাধারণ মানুষের মতো তিনিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন। কিন্তু এসব মাধ্যমে মস্তিষ্ক আর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অসংখ্য ভুল তথ্য তাঁকে বিস্মিত করে। আর তাই তিনি মন ও মস্তিষ্কের যত্ন এবং ১২টি গোপন সত্য তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে।

জীবনে এমন অনেক কিছুই ঘটবে, যার ওপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই
জীবনে এমন অনেক কিছুই ঘটবে, যার ওপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই

১. ওষুধের চেয়ে বেশি জরুরি পানি

আমাদের মস্তিষ্কের প্রায় ৭০ শতাংশই পানি। প্রতিটি কাজের জন্য পানি অপরিহার্য। শরীরের পানিশূন্যতা মারাত্মক না হলেও যদি প্রয়োজনমতো পানি না খাওয়া হয়, তাতেও মস্তিষ্ক দুর্বল হয়ে পড়ে।

পর্যাপ্ত পানি খেলে মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে ভালো কাজ করে। সহজ কথায়, আমাদের মস্তিষ্কের প্রধান জ্বালানি হলো পানি। তাই পানির বিকল্প নেই।

২. ঘুমকে অবহেলা নয়

ঘুম আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজে প্রভাব ফেলে। স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ, সিদ্ধান্ত নেওয়া, মেজাজ নিয়ন্ত্রণ, এমনকি ক্ষুধাও এর সঙ্গে সম্পর্কিত।

খেয়াল করে দেখবেন, এক রাত ঘুম ভালো না হলে পরের দিন কাজে মন বসে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আবার ক্ষুধাও যেন একটু বেশি লাগে।

মজার বিষয় হলো, আমরা যখন ঘুমাই, তখন মস্তিষ্ক নিজেকে ‘রিফ্রেশ’ করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘গ্লিমফ্যাটিক সিস্টেম’। ঘুম মস্তিষ্ককে সতেজ করে, ডিমেনশিয়ার মতো ভয়ংকর রোগের ঝুঁকি কমায়।

তাই বেশি কাজ করার জন্য ঘুম কমানোর চিন্তা না করে পর্যাপ্ত ঘুমানো দরকার। ঘুম ভালো হলে কাজও বেশি করা যায়, আবার কাজের মানও বাড়ে।

চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হবে, তবে সেটা যেন দিশাহারা করে না ফেলে
চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হবে, তবে সেটা যেন দিশাহারা করে না ফেলে

৩. সব ধরনের মানসিক চাপ খারাপ নয়

চাপ বা স্ট্রেস মানেই খারাপ, কথাটা ঠিক নয়। আদতে সব ধরনের চাপ খারাপ নয়। অল্প থেকে মাঝারি চাপ আমাদের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। চাপ না থাকলে বরং জীবনটা বিরক্তিকর হতো, সব একঘেয়ে লাগত।

চাপ খুব কম থাকলে কাজ করার কোনো উৎসাহ–অনুপ্রেরণাই থাকত না। আবার চাপ খুব বেশি বেড়ে গেলে ভয় বা অস্থিরতায় কিছুই করতে পারতাম না আমরা। তাই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হবে, তবে সেটা যেন দিশাহারা করে না ফেলে, সেদিকেও খেয়াল রাখবেন।

৪. প্রকৃতির ছোঁয়ায় মিলবে সমাধান

যখনই মনে হবে মাথায় কিছু আসছে না, ক্লান্ত লাগছে বা অনেক সময় ভেবেও কূলকিনারা পাচ্ছেন না, তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ুন, প্রকৃতির মধ্যে কিছুক্ষণ হাঁটুন।

এই সামান্য হাঁটাই মস্তিষ্ককে ‘রিসেট’ করে। মনটা নিমিষেই সতেজ হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরাও এ কথার সঙ্গে একমত হয়েছেন। প্রকৃতির মাঝে হাঁটা আদতেই উপকারী। পাশাপাশি এর সঙ্গে বাড়তি পাওয়া হিসেবে মিলবে ভিটামিন ডি।

দৈনিক হাঁটার কোটাও পূরণ হবে, আবার প্রাকৃতিক আলো আপনার শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়িটাকেও ঠিক রাখতে সাহায্য করবে।

৫. সামাজিক সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ

আজকাল অনেক ফিটনেস কোচ শরীরচর্চা, ডায়েট আর ঘুমের কথা বলেন। এসব নিঃসন্দেহে খুব জরুরি। কিন্তু এর সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে মানুষের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখা দরকার। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একাকিত্ব দিনে ১৫টি সিগারেট খাওয়ার মতো ক্ষতিকর।

তবে মনে রাখবেন, একা থাকা আর একাকিত্ব অনুভব করা এক জিনিস নয়। একজন ব্যক্তি অনেকের মধ্যে থেকেও একা অনুভব করতে পারেন। আবার কেউ একা থেকেও একাকিত্বে ভোগেন না।

আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে মানুষের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখা দরকার
আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে মানুষের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখা দরকার

৬. পেটের অবস্থাই বলে দেবে মনের স্বাস্থ্য

আমাদের পেট আর মস্তিষ্কের মধ্যে গভীর যোগাযোগ আছে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘গাট-ব্রেইন অ্যাক্সিস’। পেটের ভেতরে বাস করে কোটি কোটি অণুজীব। এসব অণুজীব আমাদের মেজাজমর্জির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

আপনার পেটের অবস্থা ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকবে না। তাই কথায় আছে, ‘পেট ঠিক তো সব ঠিক’। পেট ভালো রাখতে ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার, দই ও প্রোবায়োটিক খাবার বেশি খেতে হবে।

চিনি, অ্যালকোহল ও প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে দূরে থাকাই ভালো। আর হ্যাঁ, পর্যাপ্ত পানি খেতে হবে।

৭. উন্নতি করতে হলে কমফোর্ট জোন থেকে বের হতে হবে

আমাদের মস্তিষ্ক সব সময় নিরাপদ থাকতে চায়, ঝুঁকি নিতে চায় না। এটা টিকে থাকার উপায়। কিন্তু উন্নতি করতে চাইলে আপনাকে ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।

যে কাজ ভয়ের মনে হয় বা অস্বস্তি লাগে, সেখানেই শেখার সুযোগ আছে। ভয় মানেই থেমে যাওয়া নয়, বরং সেটাই ইঙ্গিত দেয় আপনি সঠিক পথে হাঁটছেন।

৮. সব সময় পজিটিভ থাকার ধারণাটি ক্ষতিকর

দুঃখ, রাগ বা ভয় আমাদের শত্রু নয়। এসব জীবনেরই অংশ। এসব অনুভূতিকে চেপে রাখার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সাময়িকভাবে হয়তো আপনি ভালো থাকবেন, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল হয় মারাত্মক।

আবেগ চেপে রাখলে মানসিক চাপের সঙ্গে বাড়ে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি। তাই নিজের অনুভূতিগুলোকে অস্বীকার না করে, সেসব বোঝার চেষ্টা করুন। ওসব হয়তো আপনাকে কিছু বলতে চায়। নিজের মনের কথা শুনুন।

৯. অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ক্ষতিকর

ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করলে আমাদের মনোযোগ কমে যায়। আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। অন্যের সাজানো-গোছানো, নিখুঁত জীবন দেখে আমাদের মনে হতে থাকে, আমার জীবনটা মোটেও ভালো নয়।

এটা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর। তাই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন এবং সেটা মেনে চলুন। যখন ফোন ব্যবহার করছেন না, তখন সেটা চোখের আড়াল করে অন্য জায়গায় রাখা ভালো।

একটানা কাজ করার চেয়ে নিয়মিত বিরতি নিলে আপনার কাজের মান অনেক ভালো হবে
একটানা কাজ করার চেয়ে নিয়মিত বিরতি নিলে আপনার কাজের মান অনেক ভালো হবে

১০. কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি বিশ্রাম জরুরি

বিশ্রাম মানেই আলসেমি নয়। নিজের সেরা কাজটা করার জন্য বিশ্রাম অপরিহার্য। আমাদের মস্তিষ্ক একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে পারে না। একটানা কাজ করার চেয়ে নিয়মিত বিরতি নিলে আপনার কাজের মান অনেক ভালো হবে।

বিশ্রামকে কাজের পুরস্কার হিসেবে দেখবেন না, বরং কাজ করার পূর্বশর্ত হিসেবে ভাবুন।

১১. মাল্টিটাস্কিং একধরনের ভ্রম

আমরা যখন ভাবি একসঙ্গে অনেক কাজ করছি, তখন আসলে কিছুই করছি না। আদতে আমাদের মস্তিষ্ক একসঙ্গে একাধিক কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। মূলত যেটা হয়, তা হলো আমরা খুব দ্রুত একটা কাজ থেকে আরেকটা কাজে ফিরে যাই।

এই ঘন ঘন কাজ পরিবর্তন করার কারণে আমাদের মানসিক শক্তি দ্রুত ফুরিয়ে যায়। তাই একটি সময়ে একটি কাজেই মনোযোগ দিন। দেখবেন, কাজ অনেক দ্রুত এবং ভালোভাবে শেষ হচ্ছে। মস্তিষ্কের পক্ষে মাল্টিটাস্কিং করা সম্ভব নয়।

১২. সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব

জীবনে এমন অনেক কিছুই ঘটবে, যার ওপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা না করাই ভালো। কারণ, আপনি তা বদলাতে পারবেন না। এ জন্য প্রথম ধাপ হলো মেনে নেওয়া। কিছু জিনিস যে আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তা মেনে নিন।

দ্বিতীয় ধাপ হলো, দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো। আপনি কি এর মধ্যে কোনো নতুন সুযোগ খুঁজে নিতে পারেন? এটাকে কি একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা যায়?

মনে রাখবেন, আপনার সঙ্গে কী ঘটছে, তা হয়তো আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় আপনি কী করবেন, সেই সিদ্ধান্তটা সব সময় আপনার হাতেই থাকে।

সূত্র: মিডিয়াম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *