আন্তর্জাতিক

আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠায় গড়েছিলেন কাঠ ব্যবসায়ীর ছেলে

আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠায় কামাল আতাতুর্ক বিপ্লবী সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নেন। তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি ১৫ বছর তুরস্কের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। আজ ১২ মার্চ তাঁর জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে আজকের আয়োজন।

মোস্তফা কামাল পাশা। তিনি কামাল আতাতুর্ক নামে সমধিক পরিচিত। ‘আতাতুর্ক’ তথা তুর্কি জাতির জনক পদবি তাঁর অর্জন। কারণ, তিনিই আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা। কাঠ ব্যবসায়ী বাবার ছেলে মোস্তফা কামাল গড়েছেন নতুন তুর্কি রিপাবলিক। আজ ১২ মার্চ তাঁর জন্মদিন।

কামাল আতাতুর্ক একসময়কার ওসমানী খেলাফতের অধীন থাকা সালোনিকায় ১৮৮১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে গ্রিসের অংশ এ এলাকার নাম থেসালোনিকি। ছোটখাটো সরকারি একটি পদে চাকরি করতেন তাঁর বাবা। পরে নামেন কাঠের ব্যবসায়। ছেলেকে ১২ বছর বয়সেই পাঠান সামরিক বিদ্যালয়ে। পরে ১৯০৫ সালে ইস্তাম্বুলের সামরিক একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন কামাল আতাতুর্ক।

লিবিয়ায় দখলদার ইতালি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ১৯১১ সালে দায়িত্ব পালন করেন কামাল আতাতুর্ক। ১৯১২-১৩ সালে বলকান অঞ্চলের যুদ্ধগুলোতেও তিনি অংশ নেন। তবে ১৯১৫ সালে দার্দানেলিসে মিত্রশক্তির হামলা প্রতিহত করে সামরিক খ্যাতি অর্জন করেন তিনি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তির চাপিয়ে দেওয়া শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে ১৯১৯ সালের মে মাসে আনাতোলিয়ায় জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের সূচনা করেন কামাল আতাতুর্ক। ইজমির শহর ও এর প্রত্যন্ত এলাকায় গ্রিক বাহিনীর দখলচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর জোর দেন তিনি। গ্রিকদের ওপর তাঁর বিজয়ের ফলে আরোপিত সেভরেস চুক্তির পরিবর্তে লুজান চুক্তি সই হয়।

কামাল আতাতুর্ক ১৯২১ সালে আঙ্কারায় অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। পরের বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানী খেলাফতের বিলুপ্তি হয়। ১৯২৩ সালে সেক্যুলার তুর্কি রিপাবলিক গঠিত হলে কামাল আতাতুর্ক প্রেসিডেন্ট হন। তিনি একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ওই দল ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে তুরস্ক শাসন করেছে।

আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠায় কামাল আতাতুর্ক বিপ্লবী সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নেন। এর মধ্যে ছিল নারীমুক্তি, ইসলামী প্রতিষ্ঠান বিলোপ, আরবিতে আজান নিষিদ্ধ করা, পশ্চিমা আইন চালু। আরবি বর্ণমালার জায়গায় লাতিন বর্ণমালা চালু। পোশাক-আশাকে পশ্চিমা ভাবধারার প্রচলন।

তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে মোস্তফা কামাল ১৫ বছর তুরস্কের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৩৫ সালে তাঁকে ‘আতাতুর্ক’ তথা তুর্কি জাতির জনক উপাধি দেওয়া হয়। তিনি ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর মারা যান।

চ্যালেঞ্জের মুখে ‘কামালবাদ’

তুরস্কজুড়ে কয়েক দশক ধরে আধিপত্য করেছে কামাল আতাতুর্কের ব্যক্তিত্ব। বিদ্যালয়, হাসপাতাল ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়ালে থাকা তাঁর প্রতিটি ছবি থেকে বরফ নীল চোখ দুটি যেন নিজের গড়া রিপাবলিকের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল। তাঁর সামরিক কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তৈরি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যগুলোর প্রতি যেন ঘুমন্ত নগরীগুলো ছিল শ্রদ্ধায় অবনত।

তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা ‘কেমালিজম’ তথা কামালবাদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর প্রায় ৮৫ বছর পর কামাল আতাতুর্কের মতাদর্শিক ধারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ইসলামি ভাবাদর্শিক একটি জাতির জন্য তিনি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করেছিলেন। কিন্তু সেই বিরোধ আবার সামনে এসেছে। মুসলিম বিশ্বের মডেল গণতন্ত্রে ধর্মের ভূমিকা কী হবে, সে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

তুরস্কের আধা সামরিক বাহিনীর সাবেক কমান্ডার জেনারেল সেনের এরুয়গুর বলেন, কামাল আতাতুর্ক তুর্কি জাতির ভিত গড়েছেন। তিনি চরম হতাশার সময় আশা জাগিয়েছিলেন।

ছয় বছর আগে বিরোধী ইয়নিকাগ পত্রিকার সাংবাদিক আরসলান বুলুত বলেন, মৃত্যুর প্রায় ৮০ বছর পরও আধুনিক তুরস্কের ‘পোস্টার বয়’ কামাল আতাতুর্ক। নিজেদের প্রচার-প্রচারণায় কামাল আতাতুর্কের নাম তুলে ধরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি)। তাঁর মতাদর্শিক ধারা আক্রমণের মুখে বলে মনে করেন দলটির নেতারা।

ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) ২০০২ সালে ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত কামাল আতাতুর্কের মতাদর্শিক ধারা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন জোর বিতর্ক ছিল না। এর পর থেকে এ নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। অনেকের মতে, তাঁর সংস্কার ছিল সমস্যাগ্রস্ত। কারণ, এতে ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল কারও কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না।

বুলুত বলেন, একে পার্টির কিছু ঊর্ধ্বতন নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা সংস্কারের জন্য কামাল আতাতুর্ককে দোষারোপ করে থাকেন। এটাকে তাঁরা নিপীড়নের সঙ্গে তুলনা করেন।

তুরস্কে দুই দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও তাঁর দল একে পার্টি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসের জায়গায় ওসমানি খেলাফত ও ইসলামি ঐতিহ্যের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। কামাল আতাতুর্কের জায়গায় এটিকে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চলছে।

জাতীয় ঐক্যের জায়গা

বিতর্ক আর বিভাজনের এ ধারা কিছুটা স্তিমিত হয়েছে ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টায়। ছদ্মবেশী একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা চালায়। তখন রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে সবাই রক্তাক্ত ওই সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা প্রতিহত করেন। এর পর থেকে কামাল আতাতুর্ককে নিয়ে বিভাজন কমেছে। একে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইয়াসার ইয়াকিস বলেন, ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর থেকে সরকার আর আতাতুর্ককে বিভক্তির বিষয় হিসেবে দেখে না। তিনি ঐক্যের প্রতীক।

কয়েক বছর আগেও আতাতুর্ক শব্দটি মুখে নিতেন না এরদোয়ান। তিনি এখন সিএইচপির সমালোচনা করে বলছেন, ‘ফ্যাসিস্ট’ এ গোষ্ঠীকে আতাতুর্কের মতাদর্শিক ধারা একক কবজায় রাখতে দেবেন না তিনি।

আতাতুর্কের ৭৯তম মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিনগুলোতে এরদোয়ান বলতেন, ‘মোস্তফার প্রতি আমাদের জাতির চির শ্রদ্ধা রয়েছে। আমরা খুব ভালো করেই জানি, আতাতুর্ক উপাধি নিয়ে আমাদের জাতির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। জাতি নিজ থেকেই তাঁকে এ উপাধি দিয়েছিল। তাহলে কেন এটা নিয়ে এখন বিতর্ক উঠছে?’

গুড পার্টির (আইওয়াইআই পার্টি) সহপ্রতিষ্ঠাতা আলি তুর্কসেন বলেন, ‘ওই অভ্যুত্থান চেষ্টা আমাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করেছে। এটা ছিল দ্বিতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধ।’

ধর্ম, একনায়কতন্ত্র ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের প্রশ্নে কামাল আতাতুর্কের সমালোচনা রয়েছে। তুরস্কের লেখক নেদিম গুরসেল বলেন, ‘তুরস্কে নিঃসন্দেহে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি বেশ বড় সমর্থন রয়েছে। কামালবাদ শুধু তুরস্কের জন্যই নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার মনে হয়, বর্তমান সময়ে এসে আমাদের তাঁর সমালোচনাও করা উচিত।’

তথ্যসূত্র: বিবিসি ও আল-জাজিরা

image_print
Spread the love
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments